1. [email protected] : Admin : sk Sirajul Islam siraj siraj
  2. [email protected] : admi2017 :
  3. [email protected] : Sk Sirajul Islam Siraj : Sk Sirajul Islam Siraj
ব্রেকিং নিউজ :
বিনোদন :: গান গাইতে গাইতে মঞ্চেই গায়কের মর্মান্তিক মৃত্যু!,  খেলার খবর : অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, বিমানবন্দরে যুবাদের জানানো হবে উষ্ণ অভ্যর্থনা,

সানাই সম্রাট বিসমিল্লাহ খাঁর মৃত্যুবার্ষিকী আজ

  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২১ আগস্ট, ২০২১
  • ২১৩ বার পঠিত

বিনোদন ডেস্ক :: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় সানাই সম্রাট ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ পরলোকে চলে গেছেন। ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসির হেরিটেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।

বিসমিল্লাহ খাঁ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমন্ত্রণে সানাই বাজিয়েছিলেন ঐতিহাসিক নিদর্শন লালকেল্লায়। সানাই শুনিয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের মোহিত করে ফেলেছিলেন। তখনও অবশ্যই তিনি সানাই সম্রাট হননি। পরবর্তী জীবনে শুধু ভারতবাসীকে নয়, তার সুরের মায়াজালে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে মোহিত করে স্বীকৃতি হিসেবে পান ওই উপাধি।

মহান এই সংগীতজ্ঞের একক প্রচেষ্টায় বিশ্বের দরবারে জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় সানাই। দীর্ঘ সংগীত জীবনে বিশ্বের প্রায় সব দেশের মানুষকেই সুরের জাদুতে বিমোহিত করেছেন তিনি। বিশ্বের প্রায় সব দেশের রাজধানীতে সানাই বাজিয়েছেন। সানাইকে বিশ্ব-দরবারে পরিচয় করে দিয়েছেন। প্রথম সফর বাদশাহ জহির শাহের আমলে আফগানিস্তানে। তারপর একে একে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইরাক, ইরান, কানাডা, আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান, হংকংসহ বিশ্বের নানা স্থানে, নানা প্রান্তে তিনি সানাই বাজিয়েছেন। ২০০০ সালে ঢাকাতেও অনুষ্ঠান করেছেন তিনি।

১৯১৬ সালে ২১ মার্চ হৃদয়ে সুরের নহর নিয়ে বিহারের দুমরাও অঞ্চলের এক সংগীত পরিবারে জন্ম নেন বিসমিল্লাহ খাঁ। কথিত আছে তার জন্মের সংবাদ শুনে তার দাদা বিসমিল্লা বলে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার পর থেকেই এটিই তার নামে পরিণত হয়। পারিবারিক ঐতিহ্যগতভাবেই তিনি সানাই বাজানোর চেষ্টা করতেন। তার চাচা রসুল বক্স খাঁ ভোজপুর রাজ দরবারে সানাই বাদক ছিলেন।

বিসমিল্লাহ খাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে উত্তর প্রদেশের বারানসিতে। এখানেই তার সানাইয়ে হাতেখড়ি। গঙ্গার তীর ও বালাজি মন্দিরসহ আশপাশের মন্দিরগুলোতে সানাই বাজাতে বাজাতে বেড়ে ওঠেন তিনি। সানাইয়ে মোহনীয় সুরের ঝংকার তোলেন।

বিসমিল্লাহ খাঁর বাবার নাম পয়গম্বর বক্স। মামারবাড়ি বারনসিতে। তার পিতামহ, পিতা ও তিন মামা আলী বক্স, বেলায়েত হোসেন ও সাদেক আলী প্রত্যেকেই সানাই বাদক ছিলেন। সাত বছর বয়সে লেখাপড়া শেখার জন্য বিসমিল্লাহ খাঁ মামারবাড়ি বারানসিতে চলে আসেন। তার বাবা বিসমিল্লাহকে উচ্চশিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিসমিল্লাহ খাঁ সংগীতের প্রতি ভীষণ রকম অনুরক্ত হয়ে ওঠেন। পারিবারিক ঐতিহ্যে নিজেকে অবগাহন করতে চাইলেন। ফলে লেখাপড়া আর হলো না তার। সুরের মায়াবী জগতে মনোনিবেশ করলেন। মাতুল আলী বক্সের কাছে বিসমিল্লাহর সংগীতে হাতেখড়ি। প্রথম তিনি মামার সঙ্গে তবলা সংগীত করতেন। এভাবে তাল লয়ে পাকা হয়ে উঠতে থাকেন। এরপর শুরু হলো সানাইয়ে তালিম। বারানসির সংগীতজ্ঞ মোহাম্মদ হোসেন খাঁর কাছে গানের তালিমও নিতে থাকেন। এভাবে খুব অল্প বয়সেই ঠুমরি, কাজরি ও সাওয়ানিসহ সংগীতের বেশ কিছু ধারা আয়ত্ত করে ফেলেন। পরে উচ্চাঙ্গ সংগীতের একটি ধারা খেয়ালের ওপর পড়াশোনা করেন। এ সময় কিছু জটিল ও মোহনীয় সুর আবিষ্কার করেন তিনি। তার নতুন ও ভিন্ন ধাচের এ সুর শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের সর্বত্র সাড়া ফেলে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিসমিল্লাহ খাঁ তার ওস্তাদ ফাইয়াজ খাঁর সঙ্গে এলাহাবাদ মিউজিক কনফারেন্সে অংশ নেন। সেই প্রথম সুযোগেই বাজিমাত করেন। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মিউজিক কনফারেন্সে তিনি সানাইকে সংগীতের প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে আসেন। এরপর ১৯৩৮ সালে লন্মৌতে সর্বভারতীয় বেতারের উদ্বোধন তাকে আরেকটি বড় সুযোগ এনে দেয়। ওই বছর থেকে বেতারে প্রায়ই তার সানাইয়ের সুর শোনা যেত। বিসমিল্লাহ খাঁর জীবনে এর পরবর্তী অধ্যায় সাফল্য, যশ আর খ্যাতির ইতিহাসে ভরপুর।

বারানসির গঙ্গার তীরে বেড়ে ওঠা বিসমিল্লাহ খাঁর মনপ্রাণও ছিল নদীর মতোই বিশাল উদার। জাতিগত বিভেদ, নীচুতা, বিদ্বেষ কোনো কিছুই তার কাছে স্থান পায়নি। মানুষই ছিল তার কাছে বড় পরিচয়। ব্যক্তি জীবনেও অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন সস্তা পরিবহণ রিকশা বা সাইকেলে চড়তে। তার সানাইয়ের সুর হিন্দু, মুসলমানদের এক কাতারে আনতে সক্ষম হয়েছিল। আমৃত্যু তিনি বারানসির গঙ্গার তীরে নিভৃত পল্লিতে সাধারণ মানুষের সুখ, দুঃখের সঙ্গী হয়েই থেকেছেন। একজন ধর্মপ্রাণ ও নিষ্ঠাবান মুসলমান হয়েও হিন্দুদের মন্দিরে মন্দিরে সানাই বাজিয়েছেন। এক সময় বিশ্বনাথ মন্দিরে প্রাত্যহিক কাজকর্ম শুরু হতো বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই দিয়ে। এ জন্যই ভারতে তাকে গণ্য করা হয় বহু সম্প্রদায়ের মধ্যে সমতা ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে।

বিসমিল্লাহ খাঁর জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। ভারতের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে তিনি সানাই শুনিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন। তার শেষ ইচ্ছে ছিল ইন্ডিয়া গেটে সানাই বাজাবেন। সময় নির্ধারিত হয়েছিল ৯ আগস্ট। কিন্তু তার শেষ ইচ্ছেটি পূরণ হয়নি। নিরাপত্তাজনিত কারণে সেখানে আয়োজন সম্ভব হয়নি।

বিসমিল্লাহ খাঁ মনে করতেন সংগীত হচ্ছে সমুদ্রের মতো। ৯১ বছর বয়সেও তিনি তার তীরে পৌঁছতে পারেননি। তার মতে- সাফল্যের পিছনে দৌড়ানোর চেয়ে সাধনা করে যাওয়া বেশি জরুরি। গরিব ছিন্নমূল শিশুদের জন্য তিনি ছিলেন আকাশের মতো উদার। অকাতরে বিলিয়ে দিতেন যথাসাধ্য। প্রতিদিন তার বাড়িতে বিসমিল্লাহ হোটেলে শতাধিক গরিব ও এতিম শিশুর খাওয়া দাওয়া করতো।

ব্যক্তি জীবনে বিসমিল্লাহ খাঁ অত্যন্ত সাদামাটা, প্রচারবিমুখ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন কাজে অর্থাৎ তার শিল্পসম্ভার মানুষকে দেওয়াই তার কাজ। লোক দেখানোর কিছু নেই। তিনি খুব মেজাজি মানুষ ছিলেন। সব কিছু তার পছন্দমতো ঠিকঠাক হলেই তিনি জাদুকরী সানাই বাজাতে শুরু করতেন। তার মনমতো না হলে মাইক্রোফোন ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। বিসমিল্লাহ খাঁ ১৯৫৯ সালে মাত্র একটি হিন্দি ছবিতে সানাই বাজিয়েছিলেন। ওই ছায়াছবির নাম ছিল ‘গুঞ্জ উঠি সেনহাই’ অর্থাৎ সানাইয়ের প্রতিধ্বনি। একবার এক সংগীত পরিচালক তার সানাই বাদনের সময় হস্তক্ষেপ করেন। পরিচালক তার নির্দেশিত ধারায় বাজাতে বললে তিনি ক্ষুব্ধ হন। সেই থেকে তিনি আর কখনও বলিউডমুখী হননি।

বিসমিল্লাহ খাঁ কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছিলেন। মোহাম্মদ হোসেন খাঁর তালিমে তিনি কণ্ঠসংগীতেও বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। বিশেষ করে ভজন গান। তিনি অত্যন্ত সুললিত কণ্ঠে ভজন গাইতে পারতেন। তার সেসব গান ভক্তিরসে পরিপূর্ণ ছিল।

ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ সারাটা জীবন ভারতীয় সংগীতকে অনেক কিছু দিয়েছেন। কিন্তু শেষের দিনগুলো ভালো কাটছিল না তার। ৬০ সদস্যের যৌথ পরিবার সামলাতে দারুণ হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাকে। কারণ ৬০ সদস্যের ওই সংসারে মধ্যমণি ছিলেন বিসমিল্লাহ খাঁ। খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর বেশিরভাগ যোগান দিতে তিনি। অথচ তার সানাইয়ে আকৃষ্ট হয়ে অনেক দেশই তাকে অনেক লোভনীয় প্রস্তাব দেয়। যুক্তরাষ্ট্র তাকে সেখানে নেওয়ার জন্য বারানসির রেপ্লিকা (প্রতিরূপ) স্থাপন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সবিনয়ে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা তো আমার গঙ্গাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারবেন না।’

অর্থনৈতিক অনটনের জন্য ২০০৩ সালে নিরুপায় হয়ে আবেদন জানান। তখনকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ির সরকার তার সেই আবেদনে সাড়া দেয়। ওই বছরের ৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের পক্ষ থেকে তার হাতে আড়াই লাখ রুপির একটি চেক তুলে দেওয়া হয়।

বিসমিল্লাহ খাঁ তার কাজে স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। ভারত সরকার তাকে ১৯৬১ সালে পদ্মশ্রী, ১৯৬৮ সালে পদ্মভূষণ, ১৯৮০ সালে পদ্মা বিভূষণে ভূষিত করে। সর্বশেষ ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ভারতরত্নে ভূষিত হয়েছেন ২০০১ সালে। ১৯৯৪ সালে তিনি রাজীব গান্ধী সম্মাননা পান। বেনারস হিন্দু ইউনিভারসিটি ও বিশ্বভারতী তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়া, তিনি পেয়েছেন সংগীত-নাটক একাডেমি পুরস্কার ও মধ্য প্রদেশ সরকারের তানসেন পুরস্কার। তিনি সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ ছবিতে অভিনয় করেছেন। গৌতম ঘোষ তার জীবনভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন।

বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই আর কখনো নতুন করে ঝঙ্কার তুলবে না। ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট থেমে গেছে তার সানাইয়ের সুর । কিন্তু তার রেখে যাওয়া অমর সৃষ্টি, অমর সেই সুরমূর্ছনা সানাইয়ের সুর, কোনো দিন থামবে কি?

প্লিজ আপনি ও অপরকে নিউজটি শেয়ার করার জন্য অনুরোধ করছি

এ জাতীয় আরো খবর..